- Get link
- X
- Other Apps
তামাদি বা লিমিটেশন Limitation কাকে বলে?
তামাদি শব্দটি আরবী ভাষা থেকে উদ্ভূত যার অর্থ বিলুপ্ত হওয়া বা বাধা প্রাপ্ত হওয়া। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ limitation যার অর্থ সীমাবদ্ধতা।যে কোন মামলা মোকদ্দমা দায়ের করার একটি নির্দিষ্ট সময় আছে। এই সময়ের বর্ণনা তামাদি আইনের (১৯০৮) প্রথম তফসিলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম তপশিল বর্ণিত সময়ের মধ্যে মামলা, আপিল, দরখাস্ত ইত্যাদি করতে হয়।এই সময়ের মধ্যে মামলা দায়ের না করলে আদালত তা খারিজ করে দেয়। এটি হলো তামাদি সময়। সুতরাং কোনো মোকদ্দমা, আপিল, রিভিউ, রিভিশন বা অন্যান্য দরখাস্ত কত দিনের মধ্যে আদালতে পেশ করতে হবে তা যে আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় তাকেই তামাদি আইন বলে।
তামাদি আইনের উদ্দেশ্য
তামাদি আইনের বিধান হলো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোন প্রতিকার এর প্রার্থনা করা। কেউ যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তার প্রতিকার না চায় তাহলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তার অধিকার নেই বলে তামাদি আইন ধরে নেয়। এজন্য তামাদি আইন সকলকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিচার প্রার্থনার জন্য উদ্বুদ্ধ করে।
তামাদি আইনের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা। কোন বিচার প্রার্থনা ক্ষেত্রে যত বিলম্ব হবে তার সাক্ষী, আলামত ইত্যাদি বিষয়ে তত জটিল ও অস্পষ্ট হবে। এই অবস্থা থেকে রক্ষা করে সঠিক সময়ে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করাই হল তামাদি আইনের উদ্দেশ্য।
তামাদি আইন ধরে নেয় যার দাবি সত্য, তিনি তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হবেন। আর সচেতন ব্যক্তি প্রতিকার পাওয়ার যোগ্য অর্থাৎ সচেতন ব্যক্তি তার অধিকারের বিষয়ে অবহেলা করবে না এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। সুতরাং এই সকল ব্যক্তিকে আইন সহায়তা করে থাকে।
যিনি তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকেন না বা প্রতিকারের জন্য সময়মতো আদালতে আসেন না আইন তাকে সাহায্য করবে না। তার মানে যিনি তার অধিকার সম্পর্কে উদাসীন তামাদি আইন তাকে সহায়তা করে না।
যে সকল ব্যক্তি আইনগতভাবে অক্ষম তাদের ক্ষেত্রে তামাদি আইন মেয়াদ গণনা স্থগিত রাখে। অক্ষম ব্যক্তিদের অক্ষমতার অবসান না হওয়া পর্যন্ত তামাদির মেয়াদ গণনা শুরু হয় না। সুতরাং কখনো কখনো তামাদির মেয়াদ গণনা স্থগিত রাখা ও তামাদি আইনের একটি উদ্দেশ্য।
কোন ব্যক্তির অধিকার নষ্ট করা তামাদি আইনের উদ্দেশ্য নয়। কেউ যদি নির্দিষ্ট সময় পার করে দেয় তাহলেই তামাদি আইন তার প্রতিকারের অধিকার বিনষ্ট করে দেয়।
তামাদি আইনের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে ভবিষ্যতে অতীতের কোনো বিবাদ নিয়ে যাতে আর তর্ক বিতর্ক বা মামলা-মোকদ্দমা না হয় সেই ব্যাপারে ভূমিকা রাখা। অর্থাৎ বিরোধীয় বিষয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মীমাংসা করে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখাই হচ্ছে তামাদি আইনের উদ্দেশ্য।
তামাদি আইন কে কি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আইন হিসাবে বলা যাবে কিনা?
নিম্নে কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা হলো যার মাধ্যমে বুঝা যাবে তামাদি আইন কে স্বয়ংসম্পূর্ণ আইন হিসেবে অভিহিত করা যায়।
১. তামাদি আইন একটি পদ্ধতিগত ও স্বয়ংসম্পূর্ণ আইন ২. তামাদি আইন পরস্পর বিবাদমান পক্ষসমূহের স্বার্থের দ্বন্দ্ব কে স্তব্ধ করে দেয়। ৩. তামাদি আইন কোন বিবাদ দীর্ঘকাল চলার পথে বাধা সৃষ্টি করে। ৪. আদালত তামাদির মেয়াদ বৃদ্ধি করতে পারেনা। ৫. তামাদি আইনের সকল বিধিবদ্ধ নিয়ম সন্নিবেশিত আছে। ৬. প্রয়োগের ক্ষেত্রে অন্য কোন আইনের উপর তামাদি আইন নির্ভরশীল নয়।
তামাদি আইন শুধু প্রতিকারের অধিকার কে ধ্বংস করে না, পরোক্ষভাবে অধিকার প্রদান ও করে।
তামাদি আইনের ২৬ ধারা অনুযায়ী কোন ব্যক্তি যদি বেসরকারি সম্পত্তি ২০ বছর যাবত এবং সরকারি সম্পত্তি ৬০ বছর যাবত অব্যাহতভাবে স্বীয় অধিকারে আলো, বাতাস, পানি, চলার পথের ব্যবহার ইত্যাদি অধিকার ভোগ করে তাহলে তা তার জন্য আইনগতভাবে পাকাপোক্ত হয়ে যায়। তামাদি আইন সাধারণত কারো অধিকার বিনষ্ট করে না বরং অধিকার লঙ্ঘনের প্রতিকার বিনষ্ট করে। কিন্তু ২৮ ধারা এই আইনের ব্যতিক্রম ধারা। এই ধারা অনুযায়ী স্বত্বের মোকদ্দমায় বাদিকে স্বত্ব পুনরুদ্ধারের জন্য ১২ বছরের মধ্যে মোকদ্দমা দায়ের করতে হয় কিন্তু বাদী যদি ১২ বছরের মধ্যে বিবাদীর বিরুদ্ধে খাসদখল পুনরুদ্ধারের জন্য মোকদ্দমা দায়ের না করেন তাহলে উক্ত সম্পত্তিতে বাদীর অধিকার বিনষ্ট হয়ে যায়।
তামাদির মেয়াদ অতিক্রম করার পর মোকদ্দমা দায়ের এর ফলাফল।
তামাদি আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে ৩ থেকে ২৫ ধারা অনুযায়ী প্রথম তপশিল বর্ণিত নির্ধারিত সময় উর্ত্তীর্ণ হওয়ার পর দায়েরকৃত আপিল, রিভিউ, রিভিশন, দরখাস্ত ইত্যাদি বিবাদীপক্ষ আপত্তি না দিলেও খারিজ হয়ে যাবে। তবে মোকদ্দমা ব্যতীত অন্য কোন উপায়ে অধিকার প্রয়োগ করলে তামাদি আইন বাধা সৃষ্টি করবে না।
তামাদি মেয়াদ একবার শুরু হলে তা আর বন্ধ হয় না।
কোন মোকদ্দমার নালিশের কারণ উদ্ভব হলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মোকদ্দমা দায়ের করতে হবে। এই মেয়াদ একবার শুরু হয়ে গেলে তা আর বন্ধ হয় না অর্থাৎ কোন অযোগ্যতা উক্ত মেয়াদ গণনা বন্ধ করতে পারেনা। ধারা ৯
যদি তামাদি মেয়াদ গণনার পূর্ব থেকে কেউ অযোগ্য থাকে যেমন নাবালক, পাগল, হাবা, অসুস্থ ইত্যাদি তাহলে তামাদি আইনের ৬ ও ৮ ধারার সুবিধা পাওয়া যাবে। অর্থাৎ মেয়াদ গণনা বন্ধ থাকবে কিন্তু তামাদির মেয়াদ গণনা শুরু হওয়ার পর কেউ যদি নাবালক, পাগল, হাবা, অসুস্থ ইত্যাদি হয়, তাহলে উক্ত মেয়াদ গণনা বন্ধ হবে না।
উদাহরণ: ক নামক এক ব্যক্তি খ এর জমি দখল করল। খ তার জমি থেকে বেদখল হওয়া সত্ত্বেও আদালতে গিয়ে প্রতিকার প্রার্থনা করল না বা মোকদ্দমা দায়ের করল না। খ এর কর্তব্য ছিল বেদখল হওয়ার ১২ বছরের মধ্যে মোকদ্দমা দায়ের করা। কিন্তু অবহেলায় সে ৮ বছর পার করে দেয়। এসময় খ পাগল হয়ে যায় এবং এই অবস্থায় আরো দশ বছর কেটে যায়। এক্ষেত্রে খ আর মোকদ্দমা দায়ের করার সুযোগ পাবে না। কারণ সে তার জমি থেকে বেদখল হওয়ার সময় সে সুস্থ সাবালক ছিল অর্থাৎ তামাদি মেয়াদ গণনা শুরু হয়ে যায় এবং সর্ব মোট ১৮ বছর পার হয়ে যায়। বেদখল এর পূর্ব থেকে পাগল হয়ে থাকলে ১৮ বছর পর সুস্থ হলেও সে মোকদ্দমা দায়ের সুযোগ পেত।
কোন কোন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তামাদি মেয়াদ গণনা স্থগিত থাকে।
পাওনাদারকে যদি দেনাদারের সম্পত্তি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয়া হয়, তাহলে যতদিন ওই ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব থাকবে ততদিন তামাদির মেয়াদ স্থগিত থাকতে পারে। ধারা ৯
কোনো আপিল বা দরখাস্তের প্রয়োজনীয় নকলের ক্ষেত্রে যুক্তিসঙ্গত বিলম্ব হলে তামাদির মেয়াদ স্থগিত থাকতে পারে। ধারা ১২
বিবাদী যদি অনুপস্থিত থাকে এবং বাংলাদেশের বাইরে অবস্থান করে তাহলে তা আমাদের মেয়াদ স্থগিত থাকতে পারে। ধারা ১৩
কেউ যদি সরল বিশ্বাসে এমন আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করে, যে আদালতের উক্ত মোকদ্দমা পরিচালনার ক্ষমতা নেই, তাহলে মোকদ্দমা দায়ের থেকে ভুল ধরার সময় পর্যন্ত তামাদি মেয়াদ থেকে বাদ যাবে। ধারা ১৪
কোন আদালতের আদেশ বা নিষেধাজ্ঞা দ্বারা মামলা দায়েরের পথকে রুদ্ধ করে রাখা হলে তামাদি মেয়াদ স্থগিত থাকতে পারে। ধারা ১৫
ডিক্রি জারির নিলামে খরিদা সম্পত্তির দখল পাওয়ার জন্য নিলাম খরিদ্দার কর্তৃক মামলা দায়ের করার জন্য নির্ধারিত মেয়াদ গণনার সময় নিলাম রোধের জন্য দায়েরকৃত কার্যক্রম যতদিন চলেছে, সেই সময়টুকু তামাদির মেয়াদ থেকে বাদ দেয়া যেতে পারে। ধারা ১৬
নাবালক বা আইনের দৃষ্টিতে অযোগ্য ব্যক্তির তামাদির মেয়াদ গণনা করা হয় কিভাবে।
যারা আইনগতভাবে কোন কাজ করতে পারেনা তাদেরকে আইনগত অযোগ্য ব্যক্তি বলে। যেমন নাবালক, উন্মাদ, জড়বুদ্ধিসম্পন্ন ইত্যাদি। এই সমস্ত আইনের দৃষ্টিতে অযোগ্য ব্যক্তিদের তামাদি মেয়াদের ফলাফল তামাদি আইনের ৬ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে।
যে সময় হতে তামাদির মেয়াদ গণনা করতে হবে সেই সময়ে কোন ব্যক্তি নাবালক, উম্মাদ, জড়বুদ্ধিসম্পন্ন থাকলে সেই ব্যক্তির উক্ত অযোগ্যতা অবসানের পর তামাদির মেয়াদ গণনা শুরু হবে। ধারা ৬(১)
যেমন: ক একজন উম্মাদ ব্যক্তি। তার নিজের নামের একটি জমি বেদখল হয়। নিয়ম অনুযায়ী জমি থেকে বেদখল হলে মালিকানার জন্য ১২ বছরের মধ্যে মোকদ্দমা করতে হয়। কিন্তু ক ১৫ বছর পর সুস্থ হয়। এক্ষেত্রে ক সুস্থ হওয়ার পর ১২ বছরের মধ্যে মোকদ্দমা দায়ের করতে পারবে।
কোন ব্যক্তির একটি আইনগত অযোগ্যতা চলছে। এই অবস্থায় অন্য একটি অযোগ্যতা শুরু হলে সকল অযোগ্যতার অবসানের পর তার তামাদির মেয়াদ গণনা শুরু হবে। ধারা ৬(২)। যেমন: ক একজন নাবালক ব্যক্তি। তার নিজের নামের একটি জমি বেদখল হয়। নিয়ম অনুযায়ী জমি থেকে বেদখল হলে মালিকানার জন্য ১২ বছরের মধ্যে মোকদ্দমা করতে হয়। কিন্তু নাবালক থাকা অবস্থায় সে উন্মাদ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে ক সাবালক এবং সুস্থ হওয়ার পর ১২ বছরের মধ্যে মোকদ্দমা দায়ের করতে পারবে।
কোন ব্যক্তি যদি আইনগতভাবে অযোগ্য থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে তাহলে তার প্রতিনিধি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মোকদ্দমা দায়ের করতে পারবে। ধারা ৬(৩)। যেমন: ক একজন নাবালক ব্যক্তি। তার নিজের নামে একটি জমি বেদখল হয়। নাবালক অবস্থায় ক মারা যায়। এক্ষেত্রে ক-এর সাবালক হবার তারিখ থেকে ১২ বছরের মধ্যে তার প্রতিনিধি মোকদ্দমা দায়ের করতে পারবে।
উপরোক্ত ব্যক্তি যেদিন মৃত্যুবরণ করেন, সেদিন যদি তার আইনগত প্রতিনিধি অযোগ্য থাকেন, তাহলে উক্ত প্রতিনিধি আইনগতভাবে যোগ্য হওয়ার পর তামাদির মেয়াদ গণনা শুরু হবে। ধারা ৬(৪)। যেমন: ক একজন নাবালক ব্যক্তি। আর নিজের নামের একটি জমি বেদখল হয়। নাবালক অবস্থায় মারা যায় এবং তার মৃত্যুর তারিখে তার একমাত্র প্রতিনিধি উন্মাদ অবস্থায় ছিল। এ ক্ষেত্রে উক্ত প্রতিনিধি সুস্থ হওয়ার তারিখ থেকে ১২ বছরের মধ্যে মোকদ্দমা দায়ের করতে পারবে।