- Get link
- X
- Other Apps
বাংলাদেশের লোকগীতি বা লোকসঙ্গীত Folk Music of Bangladesh
লোকগীতি বা লোকসংগীত এর উৎস হচ্ছে লোকমানস যা বংশপরম্পরায় বা যুগের পর যুগ ধরে মানুষের মুখে মুখে চলে আসে মানুষের স্মৃতি ও শ্রুতিকে ধারণ করে। প্রাচীনকালের যে নাথ গীতিকা ছিল তা থেকে শুরু হয় লোকসংগীত এবং বর্তমানে এটা ক্রমাগত বিবর্তনের মাধ্যমে বাউল মরমিয়া দেহতত্ত্ব গানের রচয়িতা নাম পাওয়া যায় যা ভনিতায় এর প্রমাণ মিলে। ভাটিয়ালি গান শুরুর দিকে ইন্ডিভিজুয়ালী বা একক ব্যক্তিকেন্দ্রিক কন্ঠে গাওয়া হলেও ক্রমে ক্রমে তা মানবসমাজে কোরাস হিসেবে একাধিক লোক গেয়ে থাকে।
সংগীতের মধ্যে তিনটি বিষয় অন্তর্নিহিত থাকে সেগুলো হচ্ছে গীতি বাদ্য ও নৃত্য। এই হিসেবে লোকগীতি, লোকবাদ্য এবং লোকনৃত্য এই তিনটির মিলনে আমরা লোকসংগীত পাই। লোকসংগীত এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হল বাউল সংগীত। কারণ বাউল সঙ্গীত এ রয়েছে গীত, বাদ্য এবং নৃত্য যা একই সঙ্গে পরিবেশিত হয়।
বাংলাদেশের লোকসংগীত বৈচিত্রে ভরা। পল্লী গ্রামের শ্রমজীবী মানুষ এর সংস্কার গত চিন্তাভাবনা ধ্যান-ধারণা, বারো মাসে তেরো পার্বণ এর উৎসব, জীবন ও জগৎ সম্পর্কে কৌতূহল, বাংলার প্রাকৃতিক নিসর্গ শোভা, নদী বিধৌত অঞ্চলের নদী ও নৌকার দৃশ্য, সমাজের দারিদ্রতা, সমাজের অন্যায় অবিচার, পারিবারিক নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র ইত্যাদি পার্থিব এবং পারিবারিক, সামাজিক বিষয় ছাড়াও অলৌকিক বিশ্বাসকে অবলম্বন করে গ্রাম বাংলার মানুষ গ্রামবাংলার মানুষের জন্য এই গান রচনা করেন। নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ হওয়ার কারণে আধ্যাত্মিকতার মরমী গান রচিত হয় যার মধ্যে রূপক অর্থে নদী ও নৌকা কে কেন্দ্র করে গাওয়া হয় এই গান।
বাংলাদেশ নদীমাতৃক হওয়ার কারণে আরেক শ্রেণীর লোকসংগীত প্রচলিত রয়েছে যা হচ্ছে বাংলা লোকসঙ্গীতে ভাটিয়ালি সুরের প্রাধান্য। বিভিন্ন দেশে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রাকৃতিক পরিবেশ কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে তেমনি ভাবে লোক সঙ্গীত এ দেশে প্রকৃতিকে অবলম্বন করে বিকাশ লাভ করে। বাংলাদেশের প্রকৃতি সব অঞ্চলে এক রকম নয়-কোথাও দেখা যায় অনুর্বর প্রস্তর ভূমি, কোথাও দেখা যায় তরাই অঞ্চল, কোথাও দেখা যায় মঙ্গা অঞ্চল, কোথাও দেখা যায় নদী ভাঙ্গন অঞ্চল। এই সমস্ত বিভিন্ন অঞ্চলের কারণে লোকসঙ্গীতের সুর সার্বজনীন রূপ লাভ না করে আঞ্চলিক রূপ লাভ করে। যেমন উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়া, পূর্বাঞ্চলের ভাটিয়ালি, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাউল মারফতি ইত্যাদি। এছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যে সমস্ত নদনদী রয়েছে তাদের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে: যেমন পদ্মা-মেঘনা সুরমা ও ধলেশ্বরী যেরূপ সেইরূপ মধুমতি, ইছামতী, ভৈরব প্রভৃতির সাথে মিলে না। তাই দেখা যায় নদনদীর সঙ্গেও জনমানুষের যে যোগসুত্র স্থাপিত হয় সেই যোগসূত্র সব জায়গাই এক রকম না, একেক অঞ্চলে একেক রকম হয়ে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই সেই অঞ্চলের লোকসংগীত এর সৃষ্টি এবং বিকাশ অন্য অঞ্চলের সাথে ভিন্ন মাত্রা দেখা যায়।
এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, ভিন্ন ভাষাভাষী আদিম জনগোষ্ঠীর যে সংস্কৃতি রয়েছে সেই সংস্কৃতি এই বাংলা বাউল গানে বা লোকসংগীতে ভীষণ রকম প্রভাব ফেলেছে। বাংলাদেশের নৃ-গোষ্ঠী বা আদিম জনগোষ্ঠী বা উপজাতিয়দের উদ্ভূত হয়েছে বিভিন্ন মানবগোষ্ঠী থেকে। তাদের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতি ভিন্ন রকমের। তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি দ্বারা বাংলাদেশের লোকসংগীত এর বিষয়, সুর এবং নৃত্য কে প্রভাবিত করেছে।
বাংলার লোকসঙ্গীতের আমরা অনেক ধরনের গানের পরিচয় পাই। এই সমস্ত গান যদি আমরা ভালো করে লক্ষ্য করে তাহলে প্রধানত যে বিষয়গুলো আমাদের চোখে পড়ে তা হচ্ছে, কিছু গান একক কন্ঠে গাওয়া হয়, কিছু গান সমবেত কণ্ঠে গাওয়া হয়। যে সমস্ত গান একক কন্ঠে গাওয়া হয় তাদের মধ্যে রয়েছে বাউল গান, ভাটিয়ালি গান, দেহতত্ত্ব গান, মুর্শিদী মারফতি গান। যে সমস্ত গান সমবেত কণ্ঠে গাওয়া হয় তাদের মধ্যে রয়েছে-কবিগান, লেটো গান,আলকাপ গান, গামভিরা গান ইত্যাদি। এই সমস্ত গান দুই বা ততোধিক ব্যক্তি সমবেত সুরে নৃত্য সহকারে গেয়ে থাকে। আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে লোকসংগীত এর কিছু গান সর্বাঞ্চলীয়, আবার কিছু গান আঞ্চলিক। লোকসংগীত শুধু বাংলাদেশ নয় পশ্চিমবঙ্গেও এর প্রাধান্য দেখা যায়। আবার কিছু গান শুধু বাংলায় বা শুধু পশ্চিমবঙ্গে দেখা যায়। আরেক ধারার কিছু গান আমরা শুনতে পাই যেগুলি সাধারনত সম্প্রদায়গত বা কমিউনিটি নির্ভর। বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য বিশেষ কিছু গীতি রয়েছে এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য বিশেষ কিছু গীতি রয়েছে এবং এ সমস্ত গানের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ধর্ম। আরেক ধারার কিছু গান রয়েছে যে গানগুলি শুধুমাত্র মেয়েদের মধ্যে প্রচলিত, যেমন ব্রত গান মেয়েলী গীত ইত্যাদি। এই বিশেষ ধরনের মেয়েলী গীত সাধারনত মেয়েরাই রচনা করে এবং তারাই পরিবেশন করে। যেমন ছাদ পেটানোর সময় নারী-পুরুষ একত্র হয়ে ছাদপেটানোর গান পরিবেশন করে।
অঞ্চল ভেদে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের লোকসঙ্গীতের যে বিভিন্ন ধারা প্রচলিত রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: বাউল এবং দেহতত্ত্ব কুষ্টিয়া, বীরভূম এবং পূর্বাঞ্চল। জারি গানের আধিক্য রয়েছে ঢাকা ময়মনসিংহ সিলেট ফরিদপুর মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে। ভাওয়াইয়া গানের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায় কুচবিহার, রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর এবং পাবনা অঞ্চলে। গম্ভীরা গানের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায় রাজশাহী, মালদহ, গাজন এবং নীল পূজা অঞ্চলে। বিয়ের গীত সব অঞ্চলেই লক্ষ্য করা যায় কিন্তু এর সুর এবং নৃত্য ভিন্ন ভিন্ন রকমের হয়। ছাদ পেটানোর গান লক্ষ্য করা যায় বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল, পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম বাঁকুড়া অঞ্চলে। সারি গানের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায় সিলেট ও ময়মনসিংহসহ ভাটি অঞ্চলে। ভাটিয়ালি গানের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায় সিলেট, ময়মনসিংহ, ঢাকা, কুমিল্লা, ফরিদপুর, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলে। রাখালিয়া লোকসঙ্গীতের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায় ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, সিলেট, হবিগঞ্জ অঞ্চলে। ব্রত গান ও মেয়েলী গীত লক্ষ্য করা যায় বাংলা এবং পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সর্বত্র। ভাদু গান লক্ষ্য করা যায় বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম বর্ধমান অঞ্চলে।
যে সমস্ত বৈশিষ্ট্য লোকসংগীত এর মধ্যে রয়েছে তা হচ্ছে: এই লোকসংগীত জনমানুষ থেকে উৎসারিত এবং মৌখিকভাবে লোকসমাজে প্রচারিত হয়। এই লোকসংগীত সম্মিলিত বা একক কন্ঠে গাওয়া হতে পারে। লোকো সংগীত গাওয়ার জন্য নিয়মিত চর্চার অনুশীলনের প্রয়োজন হয় না। সাধারণত নিরক্ষর বা অর্ধ শিক্ষিত লোক এই লোক সংগীতের রচয়িতা সুরকার এবং পরিবেশক হয়ে থাকে। লোকসঙ্গীতের ভাষা খুব সহজ সাবলীল এবং উচ্চারণে আঞ্চলিকতা থাকে এবং সুরের স্বতঃস্ফূর্ততা থাকে। লোকসংগীত এর কথা এবং সুরের সম্মেলনে একটি আবেগঘন আবেদন প্রকাশিত হয়। এই গানের সুরের মধ্যে যে সার্বজনীন আবেদন থাকে তা আঞ্চলিক ভাষায় রচিত হলেও স্ব স্ব অঞ্চল কে চিহ্নিত করে রচিত হয়ে থাকে। এই সংগীতের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে প্রকৃতি নির্ভরতা, নিসর্গ, প্রান্তর, নদী, নৌকা প্রভৃতি গ্রামীণ সংস্কৃতির উপাদান। এই সংগীতের মূল থিম বা প্রাধান্য বিষয় হচ্ছে দৈনন্দিন জীবনের দুঃখ বেদনা হাসি-কান্নার সহজ প্রকাশ। আরেকটি বিষয় লক্ষ্যনীয় যে এই সঙ্গীতের ছন্দের ব্যবহার খুব জটিল না হয়ে স্বাভাবিক হয়। মানুষের প্রেমের বিরহের মিলনের ভাবাবেগের প্রবল প্রকাশ।
লোকসঙ্গীতের সুরেও বিশেষ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। অধিকাংশ লোকসঙ্গীতের গঠনরীতি হচ্ছে মূল ভঙ্গিমাটুকু পূর্বে সন্নিবেশিত থাকে। এসব দিক বিবেচনা করলে লোকসঙ্গীতকে মোটামুটি ভাবে চার ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম শ্রেণীর সুর হচ্ছে সা রা মা পা। দ্বিতীয় শ্রেণীর সুর হচ্ছে সা গা মা পা। তৃতীয় শ্রেণীর সুরকে বিন্যস্ত করা যায়, সা রা গা পা হিসেবে। এভাবেই আরোহন করা হয় এবং চতুর্থ শ্রেণীর সুর হবে, সা রা গা মা পা। তারপর পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত সরলভাবে আরোহন করা হবে। লোকসঙ্গীতের সুরের এই বিশেষ বৈশিষ্ট্য একারণে গুরুত্বপূর্ণ যে, লোকসংগীত তা অবশ্যই কঠোর ভাবে পালন করা হয়। এছাড়াও লোকসঙ্গীতের আরও দুটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে, তা হলো: সত্যিকারের লিরিক ধর্মীয় গান যখন সুর ছাড়া শুধু কথার মাধ্যমে গাওয়া হয় যার গতি হয় পঙ্গু। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ভাটিয়ালি, বাউল ইত্যাদি গান। এমন সব গান রয়েছে যেগুলোকে সুরবাদে কেবল গান হয়না আবার কবিতা বলা দুষ্কর। যেমন ভাটের গান।
সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশের লোকসংগীতে ও পাঁচস্বরের প্রয়োগ দেখা যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় সীমান্ত এলাকার গারো সাঁওতাল ও হাজংদের গাওয়া গান। তবে এখানে অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে যে বাংলা লোকসংগীত এর যে স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে তা প্রধানত রূপ ভঙ্গি ও সাত স্বরের বিশেষ ব্যবহারের মাধ্যমে। কেবলমাত্র সুরের দিক থেকে এ লোকসংগীত ভিন্নতা রূপ লাভ করে না, ছন্দের দিক থেকেও এর মধ্যে নানা ধরনের বৈচিত্রের সৃষ্টি হয়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে রাগ সঙ্গীতের সম্পর্কে আমরা যদি বলি, তবে বলা যায় তার উদ্ভবে অবশ্যই এই লোক সংগীতের প্রভাব অনস্বীকার্য। এই কথার সাক্ষ্য হিসেবে আমাদের স্বীকার করতে হবে যে রাগরাগিণীর যে নামকরণ করা হয় তার ভূমিকা। যে সমস্ত নামকরণ করা হয় তার মধ্যে আভের, সাবেরী, মালবী, কানাড়ী, পাহাড়ী, মাঢ়, বঙ্গাল প্রভৃতি জাতির নামের সঙ্গে আমরা রাগরাগিণীর যে সমস্ত নামকরণ করা হয় তার প্রমাণ স্পষ্ট পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, বাংলা লোকসঙ্গীতেও কোনো কোনো রাগসঙ্গীতেরও প্রভাব ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়। Video বাংলাদেশের লোকসংগীত লোকগীতি ভাটিয়ালি ভাওয়াইয়া জারি-সারি মুর্শিদি