- Get link
- X
- Other Apps
Permanent settlement বা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কি?
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৬৫ সালে দিল্লির মোগল সম্রাট শাহ আলমের নিকট থেকে বার্ষিক মাত্র ২৬ লক্ষ টাকার বিনিময়ে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার রাজস্ব আদায় করার অধিকারী হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উদ্দেশ্য ছিল এদেশ থেকে মুনাফা লুণ্ঠন করা। অতঃপর তারা ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা কে স্থায়ী করার জন্য বিত্তবানদের মধ্যে একশালা, পাঁচশালা, দশশালা বন্দোবস্ত করেন। কিন্তু এতে তারা ব্যর্থ হয়। তখন তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস ভূমি রাজস্ব বিষয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিকট নতুন এক ব্যবস্থার প্রস্তাব করেন। উক্ত প্রস্তাবটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক ১৭৯৩ সালে অনুমোদিত হয়। এটি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নামে পরিচিত।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বা পার্মানেন্ট সেটেলমেন্ট এর প্রণয়নের পটভূমি:
ভারতবর্ষে মুসলিম শাসন আমলে ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার মধ্যস্বত্বভোগীর কোন স্থান ছিল না। তার পূর্বে হিন্দু শাসনামলেও এই ব্যবস্থায় মধ্যস্বত্বভোগীর কোন স্থান ছিল না। তৎকালীন সময়ে সরকার গ্রামের মাতব্বর এর সহায়তায় সরাসরি কৃষকদের সাথে যোগাযোগ রাখতো। তবে এ ক্ষেত্রে কিছু কিছু ব্যতিক্রম ছিল যেমন কোন কোন হিন্দু রাজা তাদের এলাকায় স্বাধীনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন। তারা শুধু বাৎসরিক কর প্রদান করত। কোন কোন সরকারী কর্মচারীকে নগদ টাকা বেতন না দিয়ে বিভিন্ন এলাকার রাজস্ব আদায়ের অনুমতি দিতেন। কোন কোন ক্ষেত্রে গ্রামের মাতব্বর এর উপর নির্ভর না করে সরকারি কর্মচারী সরাসরি কৃষকদের নিকট থেকে রাজস্ব আদায় করে কেন্দ্রীয় কোষাগারে জমা প্রদান করতেন।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দিল্লির মোগল সম্রাট শাহ আলম এর নিকট থেকে বার্ষিক মাত্র ২৬ লক্ষ টাকার বিনিময়ে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার রাজস্ব আদায় করার অধিকারী হয়।ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উদ্দেশ্য ছিল এদেশ থেকে মুনাফা নিয়ে যাওয়া। অল্প দিনেই শুরু হয় লুটতরাজ ও ব্যক্তিগত ও মুনাফা অর্জন। কোম্পানির ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন অনিয়ম ও সমস্যার কারণে কৃষকগণ দারুন সংকটে পড়ে যায়। একদিকে খরা ও দুর্ভিক্ষ অন্যদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লুটতরাজ। সবমিলিয়ে শুরু হয় বাংলা ১৭৭৬ সালের মনন্তর যা ছিয়াত্তরের মনন্তর নামে আজও বেশ পরিচিত।
অতঃপর তারা ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা কে স্থায়ী করার জন্য বিত্তবানদের মধ্যে একশালা, পাঁচ শালা, দশশালা বন্দোবস্ত করেন। কিন্তু এতে তারা ব্যর্থ হয়। তখন তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস ভূমি রাজস্ব বিষয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিকট নতুন এক ব্যবস্থার প্রস্তাব করেন যা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক ১৭৯৩ সালে অনুমোদিত হয় এবং এটিই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নামে পরিচিত। এই হচ্ছে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পটভূমিকা। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে বিত্তবানদের নির্দিষ্ট এলাকার ভূমি চিরদিনের জন্য মালিকানা স্বত্ব দেওয়া হয়। বিনিময় বছরে নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব কম্পানিতে জমা দিতে হবে। এভাবে রাজস্ব প্রদান করতে থাকলে ভবিষ্যতে জমির মূল্য যতই বৃদ্ধি পাক না কেন উক্ত এলাকা বংশপরম্পরায় তাদেরই মালিকানায় থাকবে।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বৈশিষ্ট্য:
১) চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বৃহৎ জমিদারি গুলিকে খন্ড খন্ড করে দেয় যার ফলে সামাজিক বিপ্লব ঘটতে শুরু করে।
২) চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিত্তবানদের মধ্যে বাৎসরিক নির্দিষ্ট রাজস্বের বিনিময় জমিদারি হস্তান্তর করা হয়। বংশানুক্রমে এই জমিদারি তারা হস্তান্তর করতে পারেন।
৩) প্রচলিত আইনের বিরুদ্ধে না হলে জমিদারির কোন ভু সম্পত্তি দান বা বিধান চালু হয়।
৪) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে জমিদারগণ তাদের সম্পত্তির কৃষি উন্নয়নের একক সুবিধা পায়, যার ফলে কৃষিতে উন্নতি হতে থাকে।
৫) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে সরকারি রাজস্ব নিশ্চিত ও স্থায়ী করা হয় অর্থাৎ জমিদারকে রাজস্ব অবশ্যই দিতে হবে অন্যথায় তার জমিদারির একটি অংশ বিক্রি করে সরকার রাজস্ব আদায় করবে।
৬) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে জমিদারদের স্বার্থ নিশ্চিত ও স্থায়ী হলেও প্রজাদের স্বার্থ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
৭) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে সরকার বিত্তবানদের কে জমিদারি মালিকানা প্রদান করেন।
৮) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে জমিদারগণ ব্যক্তিগত অধিকার ভোগ করতে পারতেন। যেমন মাছ, বনজ সম্পদ, খনিজ সম্পদ, গোচারণ ইত্যাদি ভোগ করার অধিকার লাভ করেন।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কে চিরস্থায়ী বলা হয় কেন?
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৬৫ সালে দিল্লির মোগল সম্রাট শাহ আলম এর নিকট থেকে বার্ষিক মাত্র ২৬ লক্ষ টাকার বিনিময়ে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার রাজস্ব আদায় করার অধিকারী হয়েছিল এ কারণে যে তারা যাতে এদেশ থেকে মুনাফা লুন্ঠন করতে পারে। অতঃপর তারা ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা কে স্থায়ী করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং বিত্তবানদের মধ্যে একশালা, পাঁচশালা, দশশালা বন্দোবস্ত করে কিন্তু তারা এতে সফল হয় নাই। তখন তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস এ বিষয়ে একটি নতুন ব্যবস্থার প্রস্তাব করেন। এই নতুন প্রস্তাবটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৯৩ সালে গ্রহণ করেন। আর এই নতুন প্রস্তাবটি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নামে পরিচিত হয়।
এ ব্যবস্থার মাধ্যমে বিত্তবানদের কে নির্দিষ্ট এলাকার ভূমি চিরদিনের জন্য মালিকানা স্বত্ব দেওয়া হয় এবং এর বিনিময়ে বছরে বিত্তবানদের কে নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কে দিতে বাধ্য থাকতো। রাজস্ব প্রদান করার শর্ত ছিল যে ভবিষ্যতে জমির মূল্য যতই বৃদ্ধি পাক না কেন রাজস্বের পরিমাণ নির্দিষ্ট থাকবে এবং বংশ পরম্পরায় বিত্তবানদের ওয়ারিশগণই মালিকানা স্বত্ব লাভ করবে।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যে স্বার্থ রক্ষিত হয়, তা হচ্ছে তাদের রাজস্ব নিশ্চিত হয় এবং রাজস্ব আদায় ব্যবস্থা স্থায়ী হয়। জমিদারকে রাজস্ব প্রদান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বন্যা, খরা, দুর্ভিক্ষ, মহামারী যাই হোক না কেন কোনো অজুহাত ছাড়া নির্দিষ্ট রাজস্ব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে দিতেই হতো। এক্ষেত্রে রাজস্ব মওকুফ বা রাজস্ব লাঘব বা রাজস্ব অব্যাহতির কোন ধরনের আবেদন করা যেত না। যদি কোন জমিদার তার রাজস্ব দিতে ব্যর্থ হতো, তখন শর্ত অনুযায়ী উক্ত জমিদারির একটি নির্দিষ্ট অংশ বিক্রি করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজস্ব আদায় করতো। এ সকল কারণে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কে চিরস্থায়ী নামকরণ করা হয়েছে।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত জমিদারদের স্বার্থ রক্ষা হয়েছিল- এ কথাটা কতটা সত্য?
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে জমিদারদের স্বার্থ রক্ষিত হয়েছিল -এ কথাটা পুরোপুরি সত্য। প্রজাদের স্বার্থ রক্ষা করা বা কৃষকদের স্বার্থ রক্ষা করা, তাদের কল্যাণে কাজ করা বা কৃষক রক্ষার কোন পদক্ষেপ এই বিধানে উল্লেখ করা হয়নি। যার ফলে ভূমি ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং জমিদারগণ উচ্চহারে প্রজাদের নিকট থেকে খাজনা আদায় করতে শুরু করে। জমিদারগণ কৃষকদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন আরো বেশি পরিমাণে বৃদ্ধি করতে থাকে এবং তাদের খাজনা আদায় চরম নির্মমতার পরিচয় দেয়। সরকারকে অর্থাৎ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে নির্দিষ্ট খাজনা পরিশোধ করে জমিদারগণ ভূমির মালিক হয়ে যান। এতে তাদের দাম্ভিকতা, সামাজিক প্রভাব প্রতিপত্তি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা আগ্রাসী মনোভাব প্রদর্শন করেন। শুধু তৎকালীন জমিদারগণই নয় তাদের পুত্র সন্তানরাও বংশপরম্পরায় উত্তরাধিকার সূত্রে এই জমিদারি প্রাপ্ত হন এবং তাদের কাছে মালিকানা সূত্রে এই জমি হস্তান্তরিত হয়। অথচ জমিদারগণ এর উপর সরকার যে খাজনা আরোপ করেছিলেন তা ছিল চিরদিনের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ। অর্থাৎ যে জমিদারির খাজনা ১০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল, ৫০ বা ১০০ বছর পরেও সেই ১০ হাজার টাকাই খাজনা দিতে হতো। এছাড়াও জমিদারগণ তাদের জমিদারীর সমস্ত ভূ-সম্পত্তি বা এর কোন অংশ বিক্রয়, দান, হস্তান্তর করতে পারতেন। তাই দেখা যায় জমিদারদের জন্য এই ব্যবস্থা অনেক সুফল বয়ে এনেছিল কিন্তু কৃষকদের জীবনে নেমে এসেছিল দুর্যোগের কালো আঁধার।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কখন বিলুপ্ত হয়?
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত অনুমোদন হয় ১৭৯৩ সালে। আর ১৯৪৭ সালে ইংরেজগণ এই ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে বিতাড়িত হন। অতঃপর পাকিস্তান সরকার ১৯৫০ সালে রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ইংরেজিতে যার নাম হচ্ছে State Acquisition and Tenancy Act এর মাধ্যমে উক্ত রেগুলেশনটিকে অর্থাৎ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা বাতিল করে। ১৯৫০ সালে এই আইন পাশের ফলে নির্যাতিত কৃষকগণ জমির মালিকানা লাভ করেন এবং তাদের উপর অত্যাচার, জুলুম, নির্যাতন, নিপিড়ণের অবসান হয়।
ধন্যবাদ
Shameem Sarwar
shameem.sarwar@yahoo.com
Video Land Law Permanent Settlement ভূমি আইন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত