- Get link
- X
- Other Apps
দেওয়ানি আদালত ও দেওয়ানি মামলা কাকে বলে?
দেওয়ানি মামলা দায়ের থেকে চূড়ান্ত শুনানি পর্যন্ত ধাপগুলো কি?
দেওয়ানি আদালতের এখতিয়ার কাকে বলে? দেওয়ানি মোকদ্দমার বিধিমালা কি? দেওয়ানি আদালতের এখতিয়ার বহির্ভূত মামলা।অগ্রক্রয় বা প্রিয়েমশন মামলার ডিক্রিতে কি কি উল্লেখ থাকে?
দেওয়ানী আদালত কাকে বলে?
যে আদালতে দেওয়ানী প্রকৃতির মোকদ্দমা দায়ের করা হয় তাকে দেওয়ানী আদালত বলে। সাধারনত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির স্বত্ব নিয়ে যে আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করা হয় তাকে দেওয়ানী আদালত বলে। যেমন জেলা জজ আদালত, যুগ্ম জেলা জজ আদালত, সহকারি জজ আদালত ইত্যাদি। এছাড়াও কপিরাইট, চুক্তি, ট্রেডমার্ক ইত্যাদির প্রকৃতির মামলাও দেওয়ানী প্রকৃতির মামলা।
দেওয়ানী মোকদ্দমা দায়ের পদ্ধতি বা ধাপসমূহ
প্রথম পর্যায়
দেওয়ানী কার্যবিধির ২৬ ধারা এবং ৪ আদেশ অনুযায়ী নিম্নোক্তভাবে দেওয়ানী মোকদ্দমা দায়ের এর পদ্ধতি বা নিয়ম আলোচনা করা যায়।
আর্জি পেশ করার মাধ্যমে দেওয়ানী মোকদ্দমা দায়ের করতে হবে অথবা নির্ধারিত অন্য কোন পদ্ধতিতে দেওয়ানী মোকদ্দমা দায়ের করতে হবে। আদালতে নিযুক্ত কর্মচারীদের আর্জি পেশ এর মাধ্যমে মোকদ্দমা দায়ের করতে হবে। বিবাদী যদি একাধিক হয় তাহলে বিবাদীদের উপর সমন জারির জন্য যতজন বিবাদী থাকবে ততক্ষণ আর্জেন্ট নকল দাখিল করতে হবে। যতজন বিবাদী থাকবে প্রত্যেকের সময়ের মূল্য সহ আগাম প্রাপ্তি-স্বীকারপত্র আরজে সাথে দাখিল করতে হবে। প্রাপ্তি স্বীকারপত্রে বিবাদীদের পুরনো ও সঠিক ঠিকানা যুক্ত খাম প্রদান করতে হবে। মোকদ্দমার বিচার করার এক্তিয়ার এই আদালতের আছে কিনা তা আর যেতে উল্লেখ করতে হবে। আর যদি নালিশের কারণ উল্লেখ করতে হবে। বাদি কি প্রতিকার চাই তা আর যেতে উল্লেখ করতে হবে। আর যদি অন্য কোন আইন দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয়েছে কিনা তা উল্লেখ করতে হবে। দেওয়ানী আদালতে দেওয়ানী মোকদ্দমা রেজিষ্ট্রার থাকে। উক্ত রেজিস্ট্রারে মোকদ্দমা বিবরণ লিপিবদ্ধ করতে হয়। ফৌজদারি মামলায় মাসের হিসেবে ক্রমিক নম্বর দেওয়া হয় কিন্তু দেওয়ানী মোকদ্দমায় বছরের হিসেবে ক্রমিক নম্বর দেওয়া হয়। উক্ত রেজিস্ট্রারের ক্রমিক নম্বর মোকদ্দমার ক্রমিক নম্বর হিসেবে বিবেচিত হবে।
দেওয়ানী মোকদ্দমার দ্বিতীয় পর্যায়
মোকদ্দমা রুজু হওয়ার পর নির্দিষ্ট তারিখে বিবাদী হাজির হয়ে তাদের অভিযোগের জবাব দানের জন্য আদালতে নিযুক্ত কর্মকর্তা ৫ কর্ম দিবসের মধ্যে ইস্যু করবেন। উক্ত কর্মকর্তা ৫ কর্মদিবসের মধ্যে সমন্বয় করতে ব্যর্থ হলে অসদাচরণের জন্য দায়ী হবেন। তবে আরজি দাখিলের সময় যদি বিবাদী হাজির করে বাদীর দাবি মেনে নেন তাহলে সমন প্রদান করার প্রয়োজন হয় না। মূলত বাদীর অভিযোগের বিষয়ে বিবাদীকে অবহিত করানোর জন্য সমন ইস্যু করা হয়। যার ফলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিবাদী হাজির হয়ে বাদীর আরজির জবাব দাখিল করতে পারেন।
দেওয়ানী মোকদ্দমার তৃতীয় পর্যায়
বাদীর অনুপস্থিতির কারণে মোকদ্দমা খারিজ না হলে, নিদিষ্ট তারিখের মধ্যে বিবাদী আদালতে হাজির হয়ে লিখিত জবাব দাখিল করবেন। সমন জারির ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে লিখিত জবাব দাখিল করতে হয়। তবে সঙ্গত কারণ থাকলে ৩০ কর্ম দিবস এর পরেও লিখিত জবাব দাখিল করা যায় কিন্তু তা কোনক্রমেই ৬০ কর্মদিবসের বেশী হবেনা। মূলত বাদীর আরজিতে উল্লেখিত বিষয়গুলো খণ্ডনের জন্যই বিবাদী লিখিত জবাব দাখিল করেন।
দেওয়ানী মোকদ্দমার চতুর্থ পর্যায়:
মোকদ্দমার প্রথম শুনানির দিন আদালত বাদীর আরজি এবং বিবাদীর লিখিত জবাব এর মধ্যে বিরোধপূর্ণ বিষয়ের ভিত্তিতে বিচার্য বিষয় নির্ধারণ করবেন। বিচার্য বিষয় দুই ধরনের হয়-তথ্য সংক্রান্ত বিচার্য বিষয়, আইন সংক্রান্ত বিচার্য বিষয়। বিচার্য বিষয় দ্রুত নির্ধারণ ও লিপিবদ্ধ করতে হয়। এর জন্য সময় বেঁধে দেওয়া আছে। এক পক্ষ কর্তৃক স্বীকৃত এবং অপর পক্ষ কর্তৃক অস্বীকৃত বিষয় নিয়ে বিচার্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়। প্রত্যেকটি বিরোধপূর্ণ বিষয়ের জন্য আলাদা আলাদা বিচার্য বিষয় গঠন করা হয়।
দেওয়ানী মোকদ্দমার পঞ্চম পর্যায়: শুনানি ও সাক্ষ্য গ্রহণ
দেওয়ানী কার্যবিধির ১৮ আদেশ অনুযায়ী এ পর্যায়ে এসে মোকদ্দমার শুনানি ও সাক্ষ্যগ্রহণ নেওয়া হয়। শুনানির দিন উভয় পক্ষের সাক্ষী প্রমাণ নিয়ে আদালতে হাজির হবেন। প্রথমে বাদী মোকদ্দমা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা করবেন এবং বিচার্য বিষয় অনুযায়ী সাক্ষ্য প্রদান করবেন। সাধারণত বাদীপক্ষ প্রথমে বক্তব্য রাখার অধিকারী হয়। কিন্তু বিবাদীপক্ষ যদি তাদের অভিযোগের তথ্যসমূহ স্বীকার করে এরূপ যুক্তি প্রদর্শন করে যে, বিবাদী কর্তৃক উত্থাপিত তথ্যমূলক অভিযোগ বিবেচনায় বাদীপক্ষ প্রতিকার লাভ করার অধিকারী নয় তাহলে বিবাদীপক্ষ প্রথমে বক্তব্য রাখার অধিকারী হবে। তথ্য প্রমাণ হাজির করার পর উভয় পক্ষ নিয়ে জিনিস প্রমাণ এর স্বপক্ষে আদালত এই যুক্তি প্রদান করবেন।
দেওয়ানী মোকদ্দমার ষষ্ঠ পর্যায়-রায় ঘোষণা
দেওয়ানী কার্যবিধির ২০ আদেশ অনুযায়ী মোকদ্দমার শুনানি শেষে আদালত প্রকাশ্যভাবে রায় ঘোষণা করবেন। শুনানি শেষে আদালত তখন এই রায় ঘোষণা করতে পারেন অথবা রায় ঘোষণার জন্য পরবর্তী কোন দিন ধার্য করতে পারেন। যদি পরবর্তীতে রায় ঘোষণার দিন ধার্য হয় তাহলে সকল পক্ষকে বা তাদেরকে নোটিশ প্রদান করতে হবে। রায়ের মধ্যে মোকদ্দমার সংক্ষিপ্ত বিবরণ, বিচার্য বিষয়, আদালতের সিদ্ধান্ত এবং উক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণ উল্লেখ করতে হয়।
দেওয়ানী মোকদ্দমার সপ্তম পর্যায়-ডিক্রি প্রদান:
রায় ঘোষণার ৭ দিনের মধ্যে রায়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ডিক্রি প্রদান করতে হয়। ডিক্রির মধ্যে মোকদ্দমার নম্বর, পক্ষগণের নাম, পরিচয়, তাদের দাবির বিবরণ উল্লেখ করতে হয়। পাশাপাশি যে প্রতিকার মঞ্জুর করা হয়েছে এবং অন্যান্য সিদ্ধান্ত স্পষ্টরূপে নির্দেশ করতে হয়। মোকদ্দমা খরচের পরিমাণ এবং কে কি অনুপাতে উক্ত খরচ বহন করবে অথবা কোন সম্পত্তি থেকে তা নির্বাহ করতে হবে তা উল্লেখ করতে হয়। যে তারিখে রায় দেয়া হয়েছে ডিক্রিতে সেই তারিখ দিতে হবে।
দেওয়ানী আদালতের এখতিয়ার কাকে বলে
দেওয়ানী আদালতের ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার কে দেওয়ানী আদালতের এখতিয়ার বলে অর্থাৎ দেওয়ানী আদালত কর্তৃক কোন মোকদ্দমা গ্রহণ ও বিচার করার ক্ষমতাকে দেওয়ানী আদালতের এখতিয়ার বলে।
দেওয়ানী আদালতের আঞ্চলিক এখতিয়ার
দেওয়ানী কার্যবিধির ১৬ ধারা অনুযায়ী-একটি আদালত সকল স্থানের মোকদ্দমা গ্রহণ ও তার বিচার করতে পারেনা। প্রত্যেকটি আদালতের নির্দিষ্ট আঞ্চলিক সীমানা রয়েছে। মোকদ্দমার বিষয়বস্তু যে আদালতের আঞ্চলিক সীমার মধ্যে সে আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করতে হয়। সকল আদালতের আঞ্চলিক এখতিয়ার বা সীমানা গেজেট নোটিফিকেশন দ্বারা নির্ধারণ করা আছে। এটি হলো আদালতের আঞ্চলিক এখতিয়ার। তবে হাইকোর্টের সীমানা সমগ্র বাংলাদেশ।
দেওয়ানী আদালতের আর্থিক এখতিয়ার
সকল দেওয়ানী আদালত একই মূল্যমানের দেওয়ানী মোকদ্দমা বিচার করতে পারেন না। কোন দেওয়ানের আদালত কম মূল্যমানের মোকদ্দমা বিচার করতে পারেন আবার কোন দেওয়ানী আদালত বেশি মূল্যমানের মোকদ্দমার বিচার করতে পারেন। কোন দেওয়ানী আদালত কত টাকা মূল্যমানের মোকদ্দমার বিচার করতে পারবেন তাই হলো দেওয়ানী আদালতের আর্থিক এখতিয়ার।এ কজন সহকারী জজ ১৫ লাখ টাকা, জ্যেষ্ঠ সহকারী জজের বিচারিক এখতিয়ার ২৫ লাখ টাকা এবং আপিল শুনানির ক্ষেত্রে জেলা জজের এখতিয়ার পাঁচ কোটি টাকা।পাঁচ কোটি টাকার কম মূল্যমানের কোনও মামলায় যুগ্ম-জেলা জজ আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে কোনও আপিল বা কার্যক্রম হাইকোর্ট বিভাগে বিচারাধীন থাকলে তা জেলা জজ আদালতে স্থানান্তরের বিধান রাখা হয়েছে।
দেওয়ানী আদালতের বিষয়বস্তুগত এখতিয়ার
কোন মোকদ্দমা বিষয়বস্তু বিভিন্ন রকম হতে পারে যেমন দেওয়ানী প্রকৃতির, ফৌজদারি প্রকৃতির, রাজস্ব প্রকৃতির, শ্রমশিল্প প্রকৃতির ইত্যাদি। দেওয়ানী কার্যবিধির ৯ ধারা অনুযায়ী-দেওয়ানী আদালত যেকোনো ধরনের মোকদ্দমা গ্রহণ ও তার বিচার করতে পারেনা। দেওয়ানী আদালত শুধু দেওয়ানী প্রকৃতির মোকদ্দমা গ্রহণ ও তার বিচার করতে পারে এটি হলো দেওয়ানী আদালতের বিষয়বস্তুগত এখতিয়ার।
দেওয়ানী কার্যবিধির ১৫ ধারা অনুযায়ী-প্রত্যেক মোকদ্দমা বিচার করার ক্ষমতা সম্পন্ন সর্ব নিম্ন আদালতে দায়ের করতে হবে।
প্রিয়েমশন বা অগ্রক্রয় মোকদ্দমার ডিগ্রীতে কি কি উল্লেখ থাকে?
দেওয়ানী কার্যবিধির ২০ আদেশের ১৪ বিধি অনুযায়ী অগ্রক্রয় মোকদ্দমার সম্পত্তি বিক্রয় এর বিরুদ্ধে আদালত ডিক্রি প্রদান করলে, যদি উক্ত সম্পত্তির মূল্য আদালতে জমা দেয়া না হয় তাহলে আদালত টাকা জমা দেয়ার দিন অথবা সময় নির্ধারণ করতে পারবেন। ডিক্রিতে উল্লেখিত সময়ের মধ্যে বাদী যদি সম্পত্তির মূল্য এবং খরচের টাকা জমা দেয় তাহলে টাকা জমা দেয়ার তারিখ থেকে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে। ডিক্রিতে উল্লেখিত সময়ের মধ্যে বাদী যদি সম্পত্তির মূল্য এবং খরচের টাকা জমা না দেয় বা ব্যর্থ হয় তাহলে আদালত উক্ত মোকদ্দমা খারিজের আদেশ দিতে পারেন। আদালত যদি দুই বা ততোধিক দাবীদারের পক্ষে ডিক্রি প্রদান করেন তাহলে প্রত্যেক দাবিদারকে আনুপাতিক হারে সম্পত্তির মূল্য এবং খরচের টাকা জমা দিতে হবে। সকল দাবীদারের পক্ষে ডিক্রি প্রদান না করে আদালত বিশেষ দাবীদারের পক্ষে ডিক্রি প্রদান করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে উক্ত ব্যক্তির সম্পত্তির মূল্য এবং খরচের টাকা জমা দিতে সক্ষম হলে অন্যান্য দাবিদারের অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে না।
ধন্যবাদ
Shameem Sarwar
shameem.sarwar@yahoo.com